বিজ্ঞাপন দিন

অতীতের আফগানিস্তান | আরাফাত হোসেন


পৃথিবীর একটি ভূখন্ডের নাম আফগানিস্তান। ইতিহাসের এক পরিচিত নাম। এর রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। প্রকৃতির অসাধারণ রূপ-সম্ভার নিয়ে সমৃদ্ধ এ ভূমিটি ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। নিকট অতীত থেকে এখন পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে যে দুর্ভোগ একে পোহাতে হচ্ছে, এর মূলে বিশেষভাবে বিদ্যমান আছে অবস্থানগতসুবিধা ও সমৃদ্ধি। এ যেন সেই রূপবতী নারী, যার রূপের সৌন্দয্য ও কমনীয়তা তারই উপর নেমে এসেছে অভিশাপ হয়ে। ঐতিহাসিকভাবে আফগান ভূমিটি এমন এক কেন্দ্রীয় মহাসড়কের কিনারা ঘেঁষে বিস্তৃত, যা দিয়ে সর্বদা চলাচল করছে পৃথিবীর দিকে দিকে প্রবাহিত বিচিত্র সব কাফেলা।


বর্তমানে আফগানের মানচিত্রটি চারটি শহরের ওপর অসাধারণ এক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। অপরূপ এ কারুকার্জের কারণে সৃষ্টি হয়েছে খুবই দৃষ্টিনন্দন একটি চতুর্ভূজ। দৃশ্যটি দেখতে যেমন অসাধারণ, তেমনই ইতিহাসের অনুসন্ধানী পাঠকের ভিতরেও জাগিয়ে তোলে বিশেষ এক স্মৃতিকাতরতা। পশ্চিমে হেরাত, উত্তরে বলখ, দক্ষিণে কান্দাহার, আর পূর্ব দিকে হলো কাবুল। সেই প্রাচীনকাল থেকেই এ সবগুলো শহরের প্রসিদ্ধি ছিল সর্বজনবিদিত এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ও সংস্কৃতি চর্চার দিক দিয়ে পৃথিবীর অন্য যে কোনো শহরের চাইতে এগিয়ে। যদিও বর্তমানে জাতিসংঘের ‘মানব উন্নয়ন তালিকায়’ (Human Development Index) আফগানে জীবনযাপন, অর্থনীতি, সংস্কৃতির যে পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছে, তা রীতিমত অবিশ্বাস্য ও বেদনাদায়ক। বিশেষত সেই ইতিহাস-সমৃদ্ধ চারটি শহরের পরিসংখ্যানটি কোনো সন্দেহ নেই, এতটা সমৃদ্ধ ও গৌরবময় অতীত-ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও যুগের পর যুগ যুদ্ধ আর মুক্তির সংগ্রামই তাদের এমন পতিত অবস্থার মুখোমুখি করেছে।


আফগানের ইতিহাসসমৃদ্ধ চারটি শহর— হেরাত, বলখ, কান্দাহার, কাবুল।


হেরাত’। ঐতিহাসিক এ শহরটি ইরানের সীমান্তের কাছ ঘেঁষে অবস্থিত। গ্রিকদেশের এক পর্যটক একে অভিহিত করেছেন মধ্য এশিয়ার ‘ঝুড়ি’ নামে। আজ থেকে দু’হাজার পূর্বেতিনি হেরাতের যে চিত্রায়ণ করেছেন, সে বর্ণনা অনুযায়ী বোঝা যায়- সে সময়টিতে হেরাত ছিল খুবই সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী একটি জনপদ।হিজরী সপ্তম শতকের মুসলিম ভূগোলবিদ ‘ইয়াকুত হামাভি’ হেরাত সম্পর্কে বলেন, ‘৬০৭ হিজরী মোতাবেক ১২১০ ঈসায়ীতে আমি যখন খোরাসান সফর করি হেরাতের চাইতে উন্নত, সমৃদ্ধ আর জাঁকজমকপূর্ণ শহর আর দেখিনি। সেখানে পানি সরবরাহের সুন্দর ব্যবস্থা ছিল, আর শহরজুড়ে ছিল নান্দনিক ও সৌন্দয্যমন্ডিত অনেক উদ্যান।


তিনি হেরাতের সাংস্কৃতিক অবস্থা পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেন, শহরটিতে হাফেজ, আলেম, ফকিহ্, মুহাদ্দিস এবং ওলামায়ে-কেরাম ও জ্ঞানী লোক ছিলো অসংখ্য, অগণিত। এরপর তিনি উল্লেখ করেন, হেরাত এবং সার্বিকভাবে পুরো আফগানিস্তানের সেই বিভীষিকাময় ঘটনা- বর্বর তাতারদের হিংস্র আক্রমণের কথা, যে আক্রমণ খোরাসানের ইতিহাসসমৃদ্ধ শহরগুলোর সৌন্দর্য্য ধ্বংস করে এগুলোকে পরিণত করেছিলো রীতিমত ধ্বংসস্তুপে! নিজের চোখে দেখা সে ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘কিন্তু হেরাতকে বিদ্ধ করল, সময়ের বিশাক্তচোখ। বয়ে আনল ভয়াবহ দুর্যোগ ও বিপদের কাল’। তাঁর মত একজন দক্ষ ইতিহাসবিদ আক্রমণের এ ভয়াবহতা দেখে এ পরিমাণ নির্বাক হয়েছিলেন যে, ‘ইনালিল্লাহি...’ বলা ছাড়া আর কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।


চতুর্থ শতকের ভূগোলবীদ ‘আবু ইসহাক আল ইস্তাখরি’ হেরাতকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে উৎকষপূর্ণ পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের সাথে তুলনা করে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘হেরাতের মসজিদগুলো দিনের পর দিন যেভাবে মানুষ দিয়ে ভরে থাকে এমনটা খোরাসানের, সিজিস্তা, মারওয়ান কিংবা অন্য কোথাও দেখা যায় না। মসজিদগুলোতে মানুষ শুধু যে নামাযের জন্যই আসত তা নয়, বরং মসজিদকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতো শিক্ষা-দীক্ষা পাঠদান, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নানা কর্মকান্ড’। সবমিলিয়ে কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর জীবন্ত এই মসজিদগুলো হয়ে উঠেছিল একটি প্রাণোচ্ছ্বল ও উজ্জীবিত সমাজের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।


হেরাত শহরে অসংখ্য আলেম, শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেছেন। উজবেক কবি ‘আলী শের নাওয়াই’ বলতেন, ‘তুমি হেরাত শহরে প্রতিটি কদমে কদমে একজন করে কবির সাক্ষাৎ পাবে’।


দখলদারদের বিরুদ্ধে হেরাতবাসী সবসময়ই ছিলো প্রতিরোধকামী ও আপসহীন যোদ্ধা। আজ থেকে চারদশক আগে ১৯৭৯ সালে তারা রুশ দখলদারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। জবাবে রুশবাহিনী নির্দয়ভাবে বোমা বর্ষণ করে শহরটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। তারা শহরের প্রাচীন ও বিখ্যাত স্থাপনা, রাস্তা-ঘাট সবগুলোকে স্রেফ একটা বিধ্বস্ত নগরীতে পরিণত করেছিল।


হেরাত থেকে উত্তর দিকেই হচ্ছে ‘বলখ’। বর্তমানে ‘মাজার শরীফের’ কোল ঘেঁষে গৌরব ও মর্যাদার চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক বলখ। হেরাতের মত বলখও সুপ্রাচীন মানবসভ্যতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্রীয় শহর। এ বলখের মাটিতেই সেসব মনীষিদের জন্ম হয়েছে, যারা পৃথিবীতে মানুষের চিন্তাগত অভিযাত্রায় বিপুল অবদান রেখেছেন। ইতিহাসে বলখের কিছু নাম পাওয়া যায়। সে নামগুলো থেকেও মানবসভ্যতায় বলখের গুরুত্ব বোঝা যায়। একটি নাম হলো, ‘উম্মুল মুদুন’ বা ‘নগরসমূহের মা’, কখনো একে ডাকা হত ‘হাসান’ বা ‘সুন্দরী’ নামে। 


যখনই কোনো পর্যটক বা ইতিহাসবীদ বলখের ইতিহাস রচনা করেছেন, সকলেই একটি কথা বলেছেন, ‘এ শহর থেোকে যে. পরিমাণ আলেম-উলামা বের হয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই। সব সময়ই এ শহর বড় বড় মসজিদ আর মাদ্রাসা দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল, এ শহরে মাদ্রাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য দান করা প্রচুর ওয়াক্ফকৃত সম্পদ ছিল’। এছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে আগত তালিবে-ইলমদের জন্য ছিলো পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা। থাকা-খাওয়াসহ সব ধরণের ব্যবস্থা ছিল।


ধারণ করা হয়, মনোরোগের উপর পৃথিবীর সর্বপ্রথম গ্রন্থটি রচিত হয়েছে এখান থেকেই। ‘আহমদ ইবনে সাহল আল বলখী’, তিনি সর্বপ্রথম এই মনোরোগের প্রতি সকলকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, চিকিৎসাবিদ্যার পুরোটাই হয়ে গেছে শারীরিক কেন্দ্র। মনের রোগ এবং এর নিরাময়ের ব্যাপারে সকলে উদাসীন। তিনি এ বিষয়ে সবার আগে একটি গ্রন্থ রচনা করে চিকিৎসাবিদ্যার সকল পন্ডিতকে মনোরোগের ব্যাপারে পড়াশোনা ও গবেষণা করার আহ্বান জানান এবং বলেন, আমাদের উচিত চিকিৎসাব্যবস্থকে দুইভাগ করা। এক ভাগে আলোচনা শারীরীক অসুস্থতা নিয়ে আর আরেকভাগে আলোচনা হবে মনের অসুস্থতা নিয়ে।


বিভিন্ন দিক দিয়ে অনন্য ও বৈশিষ্টপূর্ণ এ শহরটি ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গিয়ে ছিল ঐ সময়ের পরমাণুশক্তির থাবায়। ৬১৮ হিজরিতে মঙ্গোলিয়া থেকে হিংস্র তাতার বাহিনী ধেয়ে আসে এবং বলখ সহ খোরাসানের অন্যান্য শহরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা এ শহরগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। ইতিহাসবীদ ‘লুইস দুপ্রি’র মতে— ঐ সময়ের পরমানুশক্তি ছিলো তাতাররা। তিনি আরো বলেন আমেরিকার পরমাণু হামলায় জর্জরিত জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি কিছু দিনের মধ্যেই সবকিছু সামলে উঠতে পেরেছিল, কিন্তু পশ্চিম এশিয়ার এই শহরগুলো কোনোদিনও সেই বর্বর তাতারদের দাগ মুছতে পারবে না।


আফগানিস্তানের আরেকটি শহর ‘কান্দাহার’। বর্তমানে এই শহরটি সারাবিশে^ পরিচিতি লাভ করেছে তালেবানদের ঘাঁটি হিসেবে। এ শহরে বেশিরভাগ অধিবাসী জাতিগতভাবে পশতুন। তারা শুরু থেকেই তালেবানদের আত্মিক ও সামরিক শক্তি জুগিয়েছিলো। কান্দাহার আফগানিস্তানের একটি প্রাচীন শহর। আফগানরা এ শহরের মাঝে নিজেদের বৈশিষ্টের ছাপ রেখেছিলো খুব গভীরভাবে, যেভাবে ছাপ রেখেছিলো আশেপাশের অনন্য অঞ্চলেও। ঐতিহাসিকভাবে সে এলাকাগুলোকে বলা হয়, বৃহত্তর সিজিস্তান।


আবু ইসহাক আল ইস্তাখরি বলেন, ‘এ শহরের পুরুষেরা হয় খুব শক্তপোক্ত আর পৌরুষদীপ্ত। বাজারে যখন চলাফেরা করে, তখন তাদের হাতে থাকে তরবারি। মাথায় পরিধান করে তিনটি অথবা চারটি পাগড়ি। পাগড়ির রং সাধারণত লাল ও হলুদের মাঝামাঝি হয়। আবার সবুজ ও সাদা পাগড়িও দেখা যায়। তাদের দাঁড়ি অনেক লম্বা হয়। অধিকাংশই তারা হানাফি মাজহাবের। নারীরা দিনের বেলা ঘর থেকে বের হয় না। প্রয়োজন হলে রাতের অন্ধকারে তারা বের হয়’।


কান্দাহারবাসীদের আরেকটি বৈশিষ্ট হলো, আক্রমনকারীদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ক্ষিপ্রতা। এমনকি তাতারিদের আক্রমণের সামনে যখন একেরপর এক শহর ধরাশায়ী হচ্ছিল, তখন কান্দাহারবাসী তাদের পরাজিত করে ডুবিয়ে রেখেছিল হতাশায়। কান্দাহারে বীর মুজাহিদ ‘জালালুদ্দীন খাওয়ারজেম শাহ্’ হয়ে ওঠেন চেঙ্গিস খানের গলার সবচেয়ে বড় কাঁটা। তাতার বাহিনীর যে অপরাজেয় প্রতিমূর্তির ছক তৈরি হয়েছিল মানুষের সামনে, সেই মূর্তি তিনি একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন।


আফগানিস্তানের ইতিহাসসমৃদ্ধ আরেকটি শহর হলো ‘কাবুল’। বহু আগে থেকেই কাবুল আফগানিস্তানের রাজধানী। এখনো আছে। এক সময় কাবুল ছিল ‘কিং-মেকার’ বা বাদশাহ বানানোর কারিগর। কাবুলে শত শত বছর ধরে শাসন করে আসছিল মুসলিমরা। তার আশেপাশের রাজ্যগুলোও কাবুল সরকারের সাথে সমঝোতা বজায় রাখা ব্যতীত টিকে থাকতে পারত না। বিখ্যাত পর্যটক ‘আল ইদ্রিসি’ (সর্বপ্রথম তিনি বিশ্ব মানচিত্র তৈরি করেছিলেন) তার গ্রন্থ ‘নুজহাতুল মুশতাক’- এ লেখেন, ‘শাহ শাসিত রাজ্যগুলোতে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমতায় বসতে পারত না, যতক্ষণ না কাবুল সরকারের সাথে তারা চুক্তিবদ্ধ হত। কেউ যদি কাবুল থেকে বহু দূরে থাকত, তবুও তাকে এ দূরপথ অতিক্রম করে কাবুলে এসে সন্ধি করতে হত। অন্যথায় আর কোনো পথ ছিল না’।


আফগানিস্তানে কয়েক দশক ধরে যুদ্ধ-বিগ্রহ চলার পর ২১ এ স্বাধীনতার সূর্যউদিত হয়। এত কিছুর পর আজও যদি কেউ এ শহরগুলোর চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, এর প্রাচীন দালানকোঠার ধ্বংসাবশেষের দিকে মনযোগ দিয়ে তাকায়, তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারবে, এগুলো একদিন পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ও প্রাচূর্যপূর্ণ শহর ছিল।

মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

নবীনতর পূর্বতন